Aha Prem
আহা কি প্রেম..
সাতদিন ধরে আব্বুর পেছন পেছন ঘুরছি পঞ্চাশহাজার টাকার জন্য। সামনে ক্রাশের শুভ জন্মদিন। তারজন্য তেলেগু একটা সিনেমা দেখে ইউনিক একটা বার্থডে প্লান করেছি। সেই প্লান এক্সিকিউট করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু আব্বুর টাকা দেয়ার খোঁজ নাই। এদিকে বার্থডে চলে আসছে।
দিনে তিনবেলা আব্বুর সামনে গিয়ে এটা সেটা খোঁচাখুঁচি করি। আব্বুর ঘরের সামনে থেকে রান্নাঘর দেখা যায়। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বারবার রান্নাঘরে যাই আর পেঁয়াজ মরিচ কাটি। আম্মু একদিন ধমক দিয়ে বললেন, অকারণে এত পেঁয়াজ কাটতেছিস কি জন্য? একদিনে মাসের সব পেঁয়াজ কেটে ফেলে দিছিস!
কয়দিন পরপর একবার করে আব্বুর কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলি, আব্বু! টাকাটা….
আব্বু গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, পানি নিয়ে আয়!
পানি এনে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আব্বু আবার বলেন, পান বানিয়ে নিয়ে আয়।
পান বানিয়ে দিতে এসে দেখি আব্বু ফোনে কার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছেন।
”আরে আনোয়ার! কি খবর? আর বলিস না আমার খবর খুব খারাপ! ব্যবসায় লস খাইছি! ব্যাংকে নাই একটা টাকা! টাকা-পয়সার প্রচন্ড অনটন বুঝলি!”
আমাকে শোনানোর জন্যই বলা বুঝতে পেরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। কয়দিন পর আবার যাই।
আব্বু টাকাটা….
আব্বু চশমার ফাঁক দিয়ে খানিকক্ষণ কড়া চোখে তাকিয়ে থেকে বলেন, রেজাল্ট কবে?
- -দেরী আছে আব্বু!
- সামনের সেমিস্টারের পরীক্ষা কবে?
-কয়দিন আগেই তো এই সেমিস্টার শেষ হইছে, সামনের সেমিস্টার দেরী আছে। বলছিলাম যে টাকাটা……
আব্বু যেন পরের কথাটা শোনেনই নাই এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, দেরী! দেরী কই? দেখতে দেখতে বছর চলে যায়,আজ আছে কাল নাই! পড়তে বস যা!
-বইখাতা নাই তো আব্বু! ঐ টাকাটা দিলে ওর থেকে বইখাতা কিনে পড়া শুরু করবো!
আব্বু কথা খুঁজে না পেয়ে ধমক দিয়ে বলেন, তোর মাকে বল আমাকে ভাত দিতে, দুপুর আড়াইটা বাজে ভাতটা কখন দেবে?
আমি হতাশ হয়ে ফেরত চলে যাই। আব্বুর কাছ থেকে টাকা আদায় করার অন্য কোনো আইডিয়া ভাবতে থাকি। আইডিয়া মাথায় চলেও এলো।
এ সপ্তাহের পত্রিকায় ছদ্মনামে একটা লেখা দিলাম। লেখাটার সারমর্ম এমন,
“অনেক সময়ই আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের চাওয়া পূরণ করি না। হয়তো তারা আমাদের কাছে কোনো জিনিসের আবদার করছে, তাদের সেই আবদার যদি আমরা পূরণ না করি বা তাদের ধমকাধমকি করি। সেখান থেকেই ছেলেমেয়েদের খারাপ হওয়ার শুরু হয়। বাবা টাকা না দিলে চুরি,ডাকাতি শুরু করে। অথবা বাবা-মা ধমকাধমকি করলে পরবর্তীতে মন খুলে বাবা মায়ের সাথে কিছু শেয়ার করতে পারে না। হয়তো কাউকে ভালোবাসে, কিন্তু পরিবার মানবে না এই ভয়ে কখনো নিজের মনের কথা ব্যক্ত করতে পারে না।
এজন্য বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের পাশে বসিয়ে তাদের মনের কথাটা জানা, তাদের পছন্দ অপছন্দ জানা। তাদের ছোটখাটো চাহিদাগুলো পূরণ করা।”
সকাল থেকে পত্রিকাটা আব্বুর ঘরে ফেলে রেখেছি। আব্বু দুপুরে খেয়েদেয়ে পত্রিকা খুলে বসলেন। আব্বু যখন পত্রিকা পড়তে বসেন তখন গভীর মনোযোগ দিয়েই পড়েন,কোনো অংশ বাদ রাখেন না। আমি শিওর এটাও পড়বেন।
পত্রিকা পড়া শেষে সারাদিনে আব্বু আর ঘর থেকে বের হলেন না। ঘরে বসেই নামাজ আদায় করলেন। তারপর সন্ধ্যার দিকে আমাকে ডেকে পাঠালেন।
-জ্বী আব্বু? ডেকেছো?
:বস!
আমি বসলাম। আব্বু বললেন, তোর কত টাকা লাগবে?
ইয়ে মানে.. পঞ্চাশ হাজার! কলেজে ভর্তির খরচ,বই কেনা,টিউশনি….
-থাক! এত কিছু বলতে হবে না। এই নে চেক।
আমি হাত বাড়িয়ে চেক নিলাম। মনের ভেতর খুশীতে লাড্ডু ফুটছে।
-তোর ল্যাপটপটা আন,আমি একটা লেখা বলব তুই লিখবি।
আমি ল্যাপটপ এনে নোট খুলে বসলাম। আব্বু বলতে লাগলেন,
“মাঝেমধ্যে আমাদের সন্তানেরা ভুলে যায় যে আমরা তাদের জন্ম দিয়েছি না তারা আমাদের। নিজেদের তারা বাপের বাপ বলে মনে করে। বাবা যদি সন্তানকে পাশে বসিয়ে বন্ধুর মতো তার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চায় দুইদিন পর সেই সন্তান বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হলেও বাপের ঘাড়ে হাত রেখে বলবে, ‘দোস্ত! আমাদের ঝামেলাটা মিটিয়ে দাও তো!’
বাবা-সন্তানের মধ্যে যে সম্মানটা সেটা বজায় রাখতে হলেও মাঝেমধ্যে সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ জানলেও বাবা-মা চুপ থাকতে বাধ্য হন। তারমানে এই না যে বাবা জানে না সন্তান তলে তলে কোন ছেলের পেছনে লাইন মারছে আর কোন ছেলের জন্মদিন পালন করার জন্য বাবা টাকা না দিলে চুরি-চামারি করার কথা ভাবছে! আমাদের আধুনিক সন্তানরা ব্লাকমেইল করার নানান পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে,বাপ একমাসে টাকা না দিলে পত্র পত্রিকায় শিক্ষামূলক কলাম ছেপে দিচ্ছে। আরো বেশী লাই দিলে কাল হয়তো টাকা না দিলে ‘অত্যাচারী পিতা’ শিরোনামে হেডলাইন ছেপে দিবে।
আপনার সন্তানকে লাগাম দিন। নিজেকে এত চালাক ভাবতে মানা করুন।”
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ল্যাপটপে কিছুই লিখিনি।
আব্বু চোখে চশমা দিয়ে মুখের ওপর পত্রিকা ধরে গম্ভীর গলায় বললেন, ঐ ছেলেতো তোকে পছন্দ করে না। তুই ওর জন্মদিন করার জন্য হাজার হাজার টাকা নষ্ট করতেছিস এইজন্য টাকা দেইনা। আর ঐ ছেলের দোষ দিবো না। ছেলের মাথায় বুদ্ধি আছে। বুদ্ধি আছে বলেই তোর মতো ছাগল তার মনে ধরেনা। সামনে থেকে যা।
আমি মনে কষ্ট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আব্বু আমাকে ডাবল ক্রস করে গেছে এটা আমি নিতেই পারছি না। আমি কাকে পছন্দ করি সেটাও তিনি জানেন! তারপর আমাকে ছাগলও বলেছেন। আব্বুর এই ধারনা বদলাতে হবে।
- আমি নতুন একটা সিম কিনে ফোনের ওপর কাপড় রেখে আব্বুর নাম্বারে ফোন দিলাম। যথাসম্ভব মোটা গলা করে বললাম,
- হ্যালো! এটা কি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের নাম্বার?
-জ্বী বলছি!
:আমি তানভীরের মা বলছি। তানভীরকে চেনেন তো? একসময় আমরা আপনাদের পাশের বাড়িতে থাকতাম। ওর বাবার চাকরীর ট্রান্সফার হবার কারণে ময়মনসিংহ চলে এসেছি। তানভীর অবশ্য ঢাকাতেই পড়াশোনা করছে।
-হুম চিনেছি।
:আসলে আপনার মেয়েটা আমার ছেলেকে খুব পছন্দ করে।
- -আমি জানি!
- কিন্তু এটা মনে হয় জানেন না..আমাদের আর তানভীরের নিজেরও ওকে খুব পছন্দ।
-ও আচ্ছা!
: আপনার মেয়েটা খুব ট্যালেন্টেড!
-জ্বী তাতো বটেই।
- আপনার মেয়েটা খুব ট্যালেন্টেড!
- -জ্বী তাতো বটেই।
- আপনার মেয়ে এত সুন্দর লেখালেখি করে, আমার ধারনা একদিন অনেক নাম করবে, আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।
- -হু!
- আপনার যদি অমত না থাকে আমরা কি বিয়ের কথাবার্তা এগোতে পারি?
- -হু!
- আমাদের তাড়া কিছু নাই। আমার ছেলেতো এখনো কিছু করে না। একটা চাকরি-টাকরি পাক। আপনার মেয়েরও অনার্স কমপ্লিট হোক। আমি শুধু জানিয়ে রাখলাম আরকি! যাতে মেয়ের অন্য জায়গায় বিয়ের চেষ্টা না করেন।
-একগ্লাস লেবুর শরবত করে দিয়ে যা! চিনি কম দিবি!
ফোনের ওপাশ থেকে এই কথা শুনে আমি চমকে উঠে বসেছি। দেখি আব্বু আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
আব্বু ফোন নামিয়ে রেখে বললেন, আমি আগেই জানি তোর প্রশংসা তুই ছাড়া আর কেউ করবে না
আগে তোরে ছাগল বলে ভু্ল করেছি। রামছাগলও তোর থেকে ভালো।
:- লাবন্য
Collected from : Facebook by Group : ক্যাম্পাসিয়ান পরিবার